রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্যাতন সম্পর্কে কতটুকু জানেন?

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আমরা এখন কম বেশী সবাই জানি। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত এই রোহিঙ্গারা যেন পৃথিবী থেকেও বিতাড়িত। কোন দেশ তাদের জায়গা দিতে চাচ্ছে না। মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হচ্ছে তারা। সাহায্য করার জন্য নেই কেউ। কি আছে মানুষ গুলোর কপালে? কেন তারা বিতাড়িত তাই নিয়ে কথা হবে আজ।

রোহিঙ্গাদের পরিচয়

রোহিঙ্গারা মায়ানমার রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা মূলত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোন ভাষা নেই। থাকলেও তা অলিখিত। রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রচলিত গল্প আছে। সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেয়ার পর তারা বলেন, “আল্লাহ্‌র রহমে বেঁচে গেছি”। এই রহম কথা থেকেই উৎপত্তি হয়েছে রোহিঙ্গা। বার্মার সরকার এদের পড়াশোনার সুযোগ দেয় না। তাই রোহিঙ্গারা ইসলাম শিক্ষাকেই একমাত্র পড়াশোনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্ছিত হয়। সরকারের অনুমতি ছাড়া তারা ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এমনকি এদের দুই সন্তানের অধিক নেয়া যাবে না এমন অঙ্গিকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। এই জনগোষ্ঠী বহুবছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। অনেক রোহিঙ্গাকে বিনা পারিশ্রমিকে পরিশ্রম করতে হয়।

মিয়ানমার কি করছে এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সাথে?

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তে তিনটি চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় দেশটির ৯ জন পুলিশ নিহত হন। এই ঘটনাটির পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর চড়াও হয়েছে। রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রাখাইন রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনী ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালাচ্ছে। সেনাবাহিনীর দাবি, উগ্রপন্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রবাসী ইসলামপন্থীদেরও যোগসাজশ রয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির রিপোর্ট অনুযায়ী চেকপোস্টে অস্ত্রধারীদের হামলায় ঘটনার পর থেকে কথিত হামলাকারীদের খুঁজে বের করার অভিযানে অন্তত ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, চলমান সহিংসতায় বাস্তুহারা হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।

রোহিঙ্গা
দেশটির সেনাবাহিনী হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠেছে

তখন থেকে হওয়া সেনাবাহিনীর এই অভিজান আজকের রোহিঙ্গা নির্যাতন, হত্যার সূত্রপাত। সেনাবাহিনীর এই হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ভিডিও এবং ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পরেছে। সেখানে দেখা যায় কি করে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নামক নিরীহ মানুষগুলোর। বাদ যায় না একটি শিশুও। কোন শিশুর আর্তনাদে কিছু যায় আসে না তাদের। গলা টিপে, আছড়ে হত্যা করা হচ্ছে বাচ্চা গুলোকে।

হত্যা করা হচ্ছে নারীদের। নারীদের হত্যা করা হচ্ছে বিভিন্ন পৈশাচিক পদ্ধতিতে। গণধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। পুড়িয়ে হত্যা করে পৈশাচিক হাসি হাসে ওরা। মানুষের প্রতি এমন বর্বর আচরণ আগে কোথাও দেখা যায়নি।

বৌদ্ধ ধর্ম কি বলে?

বিশ্বময় মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের উপর যতটা আন্তর্জাতিক অনুরোধ এবং চাপ আছে ততটা মিয়ানমারের উপর আছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিষয়টি ধর্মের নয়, মানবতার। মহামতি গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, “জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।”

জগতের সব প্রাণীর মধ্যে নির্যাতিত রোহিঙ্গারাও আছে। বৌদ্ধদের পঞ্চশীলের প্রথম শীল হল, “প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকব এই শিক্ষাপদ গ্রহণ করছি।” মানুষ তো দূরের কথা কোনো কীট-পতঙ্গকেও হত্যা করা যাবে না।

রোহিঙ্গা
বৌদ্ধ ধর্মে একটি প্রাণী নিধনেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা

বুদ্ধ করণীয় মৈত্রী সূত্রে বলেছেন, “দিটঠা বা য়েব অদিটঠা য়ে চ দূরে বসন্তি অবিদূরে, ভূতা বা সম্ভবেসা বা সব্বে সত্তা ভবন্ত সুখিত’ত্তা।” অর্থাৎ যেসব প্রাণী দৃশ্য-অদৃশ্য, দূরে-কাছে বাস করে, যারা জন্ম গ্রহণ করেছে, যারা জন্ম গ্রহণ করেনি, যারা মাতৃগর্ভে অথবা ডিম্বের ভেতরে আছে, সেখান থেকে বহির্গত হবে তারা সবাই সুখী হোক।

আরও বলা হয়েছে, “মাতা য়থা নিয়ং পুত্তং আয়ুসা এক পুত্ত মনুরক্খে, এবম্পি সব্বভুতেসু মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং।” অর্থাৎ মা যেমন তাঁর নিজের জীবন দিয়ে হলেও একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করেন, তদ্রুপ সব প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে।

মিয়ানমার এবং সে দেশের জনগণ বুদ্ধের বাণীকে মান্য করলে কিছুতেই এমন মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে পারে না বা তা মেনে নিতে পারে না। মিয়ানমারের এই আচরণ সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য চরম লজ্জার। তাই এই সময়ে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর উচিত মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা।

 

রোহিঙ্গারা কোথায় যাবে?

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা আজ বলছে, “আমরা কোথায় যাবো? কার কাছে বিচার চাইব? আমাদের সাহায্য করার কেউ নেই। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই।”

রোহিঙ্গা
যেখানেই যাক ফিরত আসছে লাশ হয়ে

প্রতিটি দেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। আশ্রয় দিতে নারাজ সবাই। কারো দ্বার প্রান্তে গিয়ে এতটুকু সাহায্য মেলেনি তাদের। রোহিঙ্গা পরিবারে জন্ম নেয়া কি তাদের অপরাধ? কোথায় যাবে তারা?

মিয়ানমারের প্রধান সুচি এতদিন পর মুখ খুললেন

রোহিঙ্গা
নোবেল জয়ী এই নেত্রীর কাছ থেকে আশানুরূপ কোন কথা শোনা যায়নি

রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সুচি। তার ভাষ্যমতে সরকার রাখাইন রাজ্যের সবাইকে রক্ষা করছে। সেই সাথে তিনি এও বলেছেন সন্ত্রাসীদের স্বার্থ রক্ষা করতে প্রচুর ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এগুলোর কোনটি সত্যি নয়। সুচির এই বক্তব্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন হাওয়া লেগেছে।

এক বিবৃতিতে বলা হয়, সন্ত্রাসীদের উস্কে দিতে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বিভেদ করার জন্য এই তথ্যগুলো ছড়ানো হচ্ছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে ১ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এছাড়া অনুপ্রবেশের জন্য নো মেন্স ল্যান্ডে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

পরিশেষে একটি কথা বলে শেষ করতে চাই। রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতাগুলো আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে মনে করিয়ে দেয়। আমরা তখন নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অনেক বড় বড় মানুষকে পেয়েছিলাম। কিন্তু এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য কে আছে? রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অনেকে ধর্ম কে টেনে আনে তাদের বলতে চাই, মানবতার যেখানে কোন ঠাই নেই সেখানে ধর্ম কি করতে পারে?

1 thought on “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্যাতন সম্পর্কে কতটুকু জানেন?”

  1. একটি জন গুষ্টিকে তাদের বসত ভিটা থেকে নির্মম ভাবে জুর করে তাড়িয়ে দেয়া হোশ্ছে।শেখাণে তারা হাজার বছর ধরে বাস করছে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় দশ লাক রোহিঙ্গা পাসের দেশে ঢোকে পরেছে। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে যেন উপভোগ করছেন কিছু আদম সন্তানের সীমাহীন কষ্ট। মায়ানমারকে ধমক দেবার সাহস আজ কারো নেই। মুখেই যতো বড় বড় কথা। মানবাধিকারের কথা বলতে বলতে তাদের মোখে ফেণা চলে আশে। ভণ্ড।

    Reply

Leave a Comment