“সেদিন থেকে রিকশাচালকদের উপর একটা সম্মান কাজ করে”

 

বৃহস্পতিবার অফিস ডিউটির শেষার্ধে কাজ করতে একদমই মন বসেনা, আলসেমিতে পেয়ে বসে কখন বের হব কখন বের হব একটা টান মাথায় ঘুরতে থাকে। আমার মত কাজ ফাঁকিবাজ লোকদের ক্ষেত্রে এমনটা হয়। অবশ্য ভাল চাকুরীজীবিদের ক্ষেত্রে নাও হতে পারে এমন। কিছুতেই আর মন বসছিলোনা কর্মক্ষেত্রে তাই নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘন্টা আগেই বেরিয়ে পরেছি।

  • আমার মায়ের বাপ মুমূর্ষ অবস্থায় ভর্তি একটা প্রাইভেট হসপিটালে প্রায় অনেকদিন যাবৎ। তাই নিয়ম মাফিক একবার অফিস শেষে যেয়ে দেখে আসতে হয় প্রতিদিন। কর্তব্যবোধ বলতে একটা ব্যাপার আছে নাহ্! নানায় যদি আম্মাকে পয়দা না করতো তাইলে আমি আসতাম কোত্থেকে।
  • নানার সাথে দেখা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবো জম্পেশ। সারা সপ্তাহের উশুল একদিনে। তাই একটা তাড়নাবোধ কাজ করছিলো। সন্ধ্যা বেলা রিকশা পাওয়া চাঁদ কপালের ব্যাপার। এদিকওদিক রিকশার জন্য চোখ বুলাচ্ছি। তখনি সামনে এসে থামলো একটি রিকশা। যাবেন?মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো এবং ইশারায় উঠে বসতে বল্লো,কোথায় যাবো ফিরতি প্রশ্ন না করেই। বিষয়টা অবাক ও ভাল লাগলো।
  • একটু পরেই সব ভাললাগা মলিন হতে চললো। এমনিতেই তাড়াহুড়া এর মধ্যে উনি রিকশাটি কচ্ছপ গতিতে চালাতে লাগলেন সারাটি পথ। মেজাজতো বেজায় এক লাফে ২° ডিগ্রি থেকে ৩৫৯° ডিগ্রিতে গিয়ে টগবগে অবস্থা। মনে মনে ভাবলাম, নাহ রাগ প্রকাশ করা যাবেনা, দেখি এর শেষ কোথায় কি হয়! জিভ-ঠোঁট চেপে বসে আছি আসনে।
  • রিকশা থেকে নেমে ভাড়ার দ্বিগুণ একটা নোট হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞাসিলাম-

-মামা! নাম কি আপনার? (মানুষের নাম জানা আমার একটা শখ, স্বভাবও বলতে পারেন, যদিও পাঁচ মিনিট পরে মনে থাকেনা)

-নুদ্দিন, আরেহ মামা নুদ্দিন নাহ! নুরদ্দিন,  নূর উদ্দিন। (তৃতীয়বার উচ্চারণের সময় ঠিক করে বললেন)

-খুব সুন্দর নাম! -হ মামা সুন্দর! আম্মায়ও বলে। আপনি বোধয় মনে মনে রাগছেন রিকশা আস্তে আস্তে চালানোর জন্য?

-আরেহ নাহ মামা! রাগি নাই (মিষ্টি একটা মুচকি হাসি দিয়ে)

-আসলে মামা, আমার পা একটা অবস টাইফয়েড জ্বরে। তাই এ অবস্থা। (ততোক্ষণে রাগ ভ্যানিস)

-নাহ ঠিক আছে, কর্ম করে খান চুরি কিংবা অন্যকিছু তো আর করছেন না। কিংবা কারও দ্বারস্থ হচ্ছেন না অন্ততপক্ষে। আচ্ছা আপনি অন্য কোন কাজ করতে পারেন নাহ্? যেটাতে আপনার পা-এ প্রেশার না পরে।

-ছিল মামা। এখন আর নাই, সিজনাল কাম তো! বেকার না থেকে তাই রিকশা চালাতে চলে এলাম, বৌ-বাচ্চা খাওয়াতে চলে এলাম।

  • এভাবেই অনেক নুদ্দিন,নুরদ্দিন, নূর উদ্দিন আছেন আমাদের দৃষ্টির পাশে এবং আড়ালে। জীবনঘানি টেনে যাচ্ছেন শরীরের বিশেষ কোন অঙ্গ অবস-অকেজো থাকা সত্বেও। আর আবার অনেকে সর্বাঙ্গ সুস্থ্য-সবল থাকা পরেও মা-বাবা-অন্যের উপরে পা এলিয়ে খাই।এসব শরীরের রক্ত পানি করা খেটেখুটে খাওয়া মানুষগুলো আপনার আমার কাছে আহামরি কিছু চান-না,তাদের ন্যায্য পাওনা পেলেই খুশি। হর-হামেশা অনেকে আবার ৫/১০ টাকার জন্যে অনেক রিকশাচালক কে ধমকা-ধমকি এবং মারতেও দেখেছি। সার্বভৌম বাংলাদেশে আপনি যেমন নাগরিক তারাও কিন্তু নাগরিক। আপনার যদি কোন কিছুতে মতামত দেয়ার অথবা প্রতিবাদ করার অধিকার থাকে তাহলে তাদের ও আছে। অনেকে আছেন তাদের তুই/তুমি করে কথা বলেন। আপনার বয়সে বড় কোন মানুষের পেশা যাই হোক না কেন তাকে তুই/তুমি বলে সম্বোধন করার কোন অধিকার আপনার নেই। আমার, আপনার কাছ থেকে তারা যদি একটু ভালো ব্যবহার পান, দেখবেন এই মানুষটি’ই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুখী ঠিক ঐ মুহূর্তে। তাদের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বললে আপনার সম্মান কিন্তু কোন অংশে কমে যাবেনা।

ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা মানেই রিকশা। রিকশা ছাড়া একটা দিন কি কখন ভেবে দেখেছেন। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি কোন দুর্যোগ রিকশাওয়ালাদের আটকে রাখতে পারেনা। আমরা কি পারিনা তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্যটা দিতে। আপনি হয়তো বলবেন যা দেন সেটাই ন্যায্য। ভিক্ষুকদের টাকা না দিয়ে এই মানুষগুলোকে টাকা দিন। আপনার খুশি হয়ে দেয়া টাকায় এরা খুব বড়লোক হয়ে যাবেনা, খুব বেশি হলে হয়তো দুবেলা পরিবারকে ঠিক মত খাওয়াতে পারবে।

  • লেখকঃ ক্ষণিকের রাগান্বিত রিকশা আরোহী।

3 thoughts on ““সেদিন থেকে রিকশাচালকদের উপর একটা সম্মান কাজ করে””

Leave a Comment